প্রতি বছরে ১৬ লাখ টাকা হারে পাাঁচ বছরের জন্য সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলার মধ্যবর্তী স্থান সুরমা নদীর ‘তিলকপুর-শিবেরখলা বালু মহাল’ বালু উত্তোলনের জন্য বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন।
কিন্তু ইজারাদাররা নির্ধারিত সীমার বাইরে যেয়েও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর দুই তীরে তীব্র ভাঙনে ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। আর এ নদী ভাঙন ঠেকাতে সরকার দুই ধাপে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে তীরবর্তী জনপদ, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যে কারণে বালু উত্তোলনের জন্য নদী ইজারা দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে- বিশ্বনাথের পরগনা বাজারের মসজিদ, দুটি মাজার, লামাকাজি-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক, লামাকাজি-পরগণাবাজার-আকিলপুর সড়কসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
এছাড়া, বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের মহাতাবপুর, রাজাপুর, আকিলপুর, কলিম উল্লাহপুর, সুবলপুর, রসুলপুর, হাজারীগাঁও, তিলকপুরসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের বাসিন্দাদের ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
অপরদিকে, এলাকার নদী ভাঙন রোধে ২০১৮ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের থেকে ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় চলতি বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দ্বিতীয় ধাপে আরও ১২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইজারা নিয়ে এ নদী থেকে গত দু'বছর ধরে বালু উত্তোলন করছেন এডভোকেট নাসিম আহমদ নামের এক ব্যক্তি। সিলেট নগরীর সুবিদবাজারের বাসিন্দা নাসিম তার বড়ভাই মশউদ আহমদের লাইসেন্স দিয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে ইজারা নিয়েছেন। এর আগে আরও তিন বছর বালু উত্তোলন করেছেন নুরুল হুদা নামের অন্য এক ব্যবসায়ী।
সূত্র মতে, চলতি বছর ১৬ লাখ টাকায় মশউদ আহমদের লাইসেন্সে সিলেট সদর উপজেলার তিলকপুর-শিবেরখলা বালুমহাল এক বছরের ইজারা দেন সিলেটের জেলা প্রশাসক। সেখানকার সার্ভেয়াররা ইজারাদেরকে বালু উত্তোলনের সীমানাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, তিলকপুর-শিবেরখলা মৌজায় ইজারা নিয়ে দিনের বেলা বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের আমিরুল্লাহাজ মৌজায় আর রাতের বেলা একই ইউনিয়নের গৌরী শংকর ও হাজরাই মৌজা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দিনে-রাতে ১০/১৫টি স্টিলের নৌকা দিয়ে সমান তালে বালু উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সরেজমিন নদী ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর একপাড়ে একসঙ্গে চারটি নৌকা দিয়ে সুরমা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আবার সরকারি বরাদ্দের বালু ভর্তি বড় বড় বস্তা ফেলে নদী পাড়ের ভাঙা জায়গা ভরাট করছেন দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বনাথের রাজাপুর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ইজারা অনুযায়ী শিবেরখলা মৌজা থেকে বালু-মাটি উত্তোলনের কথা থাকলেও ইজারাদার গভীর রাত থেকে ১৫/২০টি নৌকা নিয়ে এসে আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই মৌজার অংশে বালু-মাটি উত্তোলন করেন।
তাছাড়া ইজারাবিহীন অংশে অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলনে বাঁধা দিলে ইজারাদাররা এলাকাবাসীকে মিথ্যা চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের মামলা করার হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ করেন তারা।
অভিযোগ অস্বীকার করে ইজারাদার এডভোকেট নাসিম আহমদ বলেন, রাতে নয়, দিনেই নিজ তার নির্ধারিত সীমানায় বালু উত্তোলন করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
লামাকাজী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো নুরুজ্জামান বলেন, নদী ভাঙনের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বিশ্বনাথবাসী। ভাঙনের ফলে সুরমা নদী নিজের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শকর মৌজায় অবস্থান করছে।
‘তাই বিশ্বনাথের আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শকর মৌজা ও সদরের শিবেরখলা মৌজার সঠিক সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি,’ যোগ করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্ণালী পাল বলেন, বালু উত্তোলনের সীমানা নির্ধারণসহ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে এ বিষয়টি জানিয়েছি।’
সিলেট সদর উপজেলার ইউএনও মহুয়া মমতাজ বলেন, ‘সার্ভেয়ার পাঠিয়ে ইজারাদারদেরকে বালু-মাটি উত্তোলনের জন্য ইজারাকৃত অংশের সীমানা ও দাগ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে বালু-মাটি উত্তোলনের অভিযোগে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তিন আরও বলেন, ‘মৌজার সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি জটিল, তাই এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করতে হবে।’
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রেভিনিউ) মোহাম্মদ নাসির উল্লাহ খান বলেন, ‘ইজারার নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গিয়ে বালু-মাটি উত্তোলনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’